বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট: বাংলাদেশে খরচ এবং সেরা হাসপাতালের তালিকা
- 25 Jan 2025
- Best Doctor List
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, যা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন নামে পরিচিত, একটি জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি সাধারণত এমন রোগীদের জন্য প্রযোজ্য যাঁদের রক্ত বা ইমিউন সিস্টেম গুরুতর অসুস্থতায় আক্রান্ত। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছর গুলোতে এই চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় হাসপাতাল এ ধরনের সেবা প্রদান করছে। এই লেখায় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সংক্রান্ত খরচ, সুবিধা, এবং সেরা হাসপাতালের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট
বোন ম্যারো আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ যা রক্ত কোষ তৈরি করে। যখন এটি সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন ক্যান্সার, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া বা জটিল রক্তজনিত রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সমস্যা গুলোর সমাধানে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কার্যকর। চিকিৎসা পদ্ধতিটি প্রধানত দুই ধরনের—অটোলগাস (নিজের কোষ) এবং অ্যালোজেনেইক (অন্যান্য দাতার কোষ)। উভয় পদ্ধতিরই নির্দিষ্ট সুবিধা ও ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের খরচ তুলনামূলক ভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় সাশ্রয়ী। তবে এটি রোগের জটিলতা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সংখ্যা এবং দাতার সাথে সামঞ্জস্য নির্ভর করে। সাধারণত খরচ ২০-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। যদিও এটি অনেকের জন্য ব্যয়বহুল, সরকার এবং কিছু অলাভজনক সংস্থা এ ধরনের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কি?
অস্থি মজ্জা, যা হাড়ের ভেতরে স্পঞ্জি টিস্যু হিসেবে অবস্থান করে, আমাদের দেহে রক্তের কোষ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে যদি এই মজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত বা অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন শরীর স্বাভাবিকভাবে রক্তকণিকা তৈরি করতে পারে না। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে অস্থি মজ্জা ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত মজ্জাকে সুস্থ স্টেম সেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। নতুন স্টেম সেল দেহে রক্তকণিকার স্বাভাবিক উৎপাদন পুনরুদ্ধারে সাহায্য করে।
অস্থি মজ্জা ট্রান্সপ্লান্টের তিনটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে। অটোলজাস ট্রান্সপ্ল্যান্টে রোগীর নিজস্ব স্টেম সেল ব্যবহার করা হয়। অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্টে সামঞ্জস্যপূর্ণ দাতার স্টেম সেল ব্যবহার করা হয়। আর আম্বিলিক্যাল কর্ড ব্লাড ট্রান্সপ্ল্যান্টে নবজাতকের নাভির রক্ত থেকে স্টেম সেল নেওয়া হয়। প্রতিটি পদ্ধতি নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা ও প্রয়োজনের ওপর।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট দ্বারা কোন অবস্থার চিকিৎসা করা হয়?
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (BMT) আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি অভূতপূর্ব আবিষ্কার, যা বিভিন্ন জটিল রোগের নিরাময়ে কার্যকর। এটি রক্ত এবং ইমিউন সিস্টেমের রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রথমত, শ্বেতকণিকাধিক্যঘটিত রক্তাল্পতা বা লিউকেমিয়া রোগীদের চিকিৎসায় এটি অগ্রগণ্য। এই জটিল রক্তজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন কার্যকর সমাধান। তদ্ব্যতীত, লিম্ফোমা ও একাধিক মেলোমার মতো ক্যান্সারও এই পদ্ধতিতে নিরাময়যোগ্য।
দ্বিতীয়ত, জিনগত রক্তরোগ যেমন থ্যালাসেমিয়া ও সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার চিকিৎসায় বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো এমন জটিল অবস্থা, যেখানে রক্তকণিকার বিকৃতি বা অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এই রোগীদের জন্য অস্থি মজ্জার প্রতিস্থাপন একটি নতুন ভাবে বাঁচার আশা নিয়ে আসে।
এছাড়াও, ইমিউন সিস্টেমের ব্যাধিগুলোর চিকিৎসায়ও BMT ব্যবহৃত হয়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে যেসব রোগী বিভিন্ন সংক্রমণ ও জটিলতার শিকার হন, তাদের জন্য এই পদ্ধতি কার্যকর চিকিৎসা প্রদান করে। বাংলাদেশের চিকিৎসাবিদরা সর্বোত্তম ফলাফল নিশ্চিত করতে রোগীদের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়নের মাধ্যমে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টের খরচ কত?
বাংলাদেশে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি জটিল ও উচ্চমানের পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চিকিৎসার খরচ বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। ট্রান্সপ্ল্যান্টের ধরন যেমন অটোলগাস, অ্যালোজেনিক বা নাভির কর্ড ব্যবহৃত হলে খরচে ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রক্রিয়া শুরুর আগে রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খরচের একটি অংশ বরাদ্দ করতে হয়। এছাড়া, ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরবর্তী হাসপাতালে থাকার সময়কাল এবং সঠিক পরবর্তী যত্নের প্রয়োজনীয়তা খরচে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
গড়ে, বাংলাদেশে এই চিকিৎসার খরচ প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ মার্কিন ডলারের মধ্যে থাকে। আন্তর্জাতিক তুলনায়, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে, যেখানে এই প্রক্রিয়ার খরচ ১,০০,০০০ ডলারের বেশি হতে পারে, বাংলাদেশে এই চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে অনেক সাশ্রয়ী।
এই সাশ্রয়ী খরচ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্যও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে রোগীর ব্যক্তিগত শারীরিক অবস্থা, নির্ধারিত হাসপাতাল ও ব্যবহৃত প্রযুক্তি অনুযায়ী খরচ পরিবর্তিত হবে। সঠিক চিকিৎসা এবং কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট: কম খরচ ও সেরা সেবার আশ্বাস
বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে এক নতুন যুগের সূচনা হলো এভারকেয়ার হাসপাতাল, চট্টগ্রামের উদ্যোগে। বোন ম্যারো (অস্থি মজ্জা) ট্রান্সপ্লান্ট এবং রক্তের জটিল রোগের চিকিৎসায় দেশের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী এবং উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে চালু হয়েছে একটি বিশেষায়িত সেন্টার। এই সেন্টারটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর হেমাটোলজি এন্ড বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, যা এখন থেকে চট্টগ্রামের বাসিন্দাসহ সারা দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে।
এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে যে, এখানে ব্লাড ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া, অ্যাপ্ল্যাসটিক অ্যানিমিয়ার মতো রক্তের বিভিন্ন জটিল রোগের বিশেষায়িত চিকিৎসা পাওয়া যাবে। রোগীরা সেন্টারে মাসিক কনসালটেশন, দৈনিক টেলিমেডিসিন সেবা এবং কেমো ডে-কেয়ারের মতো সেবাগুলোও গ্রহণ করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ্, যিনি সৌদি আরবের কিং ফয়সাল স্পেশালিস্ট হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ৯ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তিনি এখানে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবেন। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এই সেন্টারটিকে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবার মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট এর সেরা হাসপাতালের তালিকা
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সেবা প্রদানে শীর্ষস্থানীয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত গবেষণার সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের জন্য কার্যকরী চিকিৎসা প্রদান করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), এবং এপোলো হাসপাতাল। এ ছাড়াও কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল যেমন এভারকেয়ার এবং ইউনাইটেড হাসপাতাল এই চিকিৎসা প্রদানে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে।
এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা
বৈশিষ্ট্য:
- বাংলাদেশের প্রথম JCI-স্বীকৃত হাসপাতাল।
- দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক অ্যালোজেনিক বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (BMT) পরিচালনার রেকর্ড।
আসগর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
বৈশিষ্ট্য:
- আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সজ্জিত।
- অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন পরিষেবা প্রদান।
- চিকিৎসায় মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির উপর বিশেষ জোর।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (DMCH)
বৈশিষ্ট্য:
- বাংলাদেশের প্রাচীনতম তৃতীয় স্তরের হাসপাতাল।
- প্রায় 2,300 শয্যা বিশিষ্ট।
- প্রতিদিন প্রায় 3,500 রোগীর সেবা।
- নতুন একাডেমিক ও হাসপাতাল ভবনে অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনের সুবিধা।
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা
বৈশিষ্ট্য:
- উন্নত হেমাটোলজি এবং অনকোলজি বিভাগ।
- রোগীর নিরাপত্তা ও আরামের উপর জোর দিয়ে অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন।