ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

  • 08 Nov 2024
  • Health Tips

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সবথেকে বেশি দেখা যায়। চলতি বছরে বাংলাদেশে এই রোগটিতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৩০ জনে। এছাড়াও বর্তমানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। 

ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করা ও চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অবহেলা করলে এটি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই ব্লগে আমরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। নিচে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ থেকে শুরু করে ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় আমরা ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করবো।

ডেঙ্গু রোগের প্রকারভেদ

ডেঙ্গু রোগের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। এগুলো তীব্রতা এবং উপসর্গের উপর ভিত্তি করে ভাগ করা যায়। নিচে ডেঙ্গুর প্রধান প্রকারগুলো তুলে ধরা হলোঃ

প্রকারভেদবৈশিষ্ট্যসাধারণ উপসর্গঝুঁকির মাত্রা
ক্লাসিকাল ডেঙ্গু ফিভারএটি ডেঙ্গুর সাধারণ প্রকার এবং এটি সাধারণত তীব্র হয় না। উচ্চমাত্রার জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা, ত্বকে র‍্যাশ।নিম্ন
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF)ডেঙ্গুর জটিল ধরন, যেখানে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে।উপরের সব উপসর্গের সাথে সাথে নাক, মাড়ি ও চামড়া থেকে রক্তপাত। মাঝারি থেকে উচ্চ
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)ডেঙ্গুর সবচেয়ে তীব্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ রূপ।তীব্র রক্তচাপ কমে যাওয়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস, শক বা অচেতন অবস্থা।অত্যন্ত উচ্চ

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণসমূহ

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে শরীরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। এগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৪-১০ দিনের মধ্যে রোগীর শরীরে প্রকাশিত হয়। ডেঙ্গুর লক্ষণসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ 

  • হঠাৎ তীব্র জ্বর, যা কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে।
  • কপালের অংশে তীব্র মাথাব্যথা।
  • চোখের পেছনে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া।
  • শরীরের বিভিন্ন পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা।
  • ত্বকে লালচে র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
  • বারবার বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব অনুভূত হওয়া।
  • খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া।
  • কিছু ক্ষেত্রে নাক ও মাড়ি থেকে হালকা রক্তপাত হতে পারে।

উপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ ডেঙ্গু দ্রুত জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

ডেঙ্গু রোগের সনাক্তকরণ

ডেঙ্গু রোগের দ্রুত চিকিৎসার জন্য এটি সঠিকভাবে সনাক্তকরণ অত্যন্ত জরুরি। ডেঙ্গু শনাক্ত করতে প্রধানত কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, যেমন এনএস১ অ্যান্টিজেন (NS1 Antigen) টেস্ট, আইজিজি ও আইজিএম (IgG ও IgM) অ্যান্টিবডি টেস্ট, এবং CBC (Complete Blood Count)। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি এবং রোগের তীব্রতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়।

এনএস১ অ্যান্টিজেন (NS1 Antigen) টেস্টঃ ডেঙ্গু সনাক্তকরণে এনএস১ অ্যান্টিজেন টেস্ট অন্যতম। এটি ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাথমিক উপস্থিতি প্রথম সপ্তাহেই শনাক্ত করতে পারে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তুলনামূলক দ্রুত ডেঙ্গু নির্ণয় করা সম্ভব। 

আইজিজি ও আইজিএম (IgG ও IgM) অ্যান্টিবডি টেস্টঃ এই পরীক্ষাগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রভাবে শরীরের ইমিউন এর প্রতিক্রিয়া শনাক্ত করে। IgM অ্যান্টিবডি, সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে সৃষ্টি হয়, যা ডেঙ্গুর সাম্প্রতিক সংক্রমণ নির্দেশ করে। অন্যদিকে, IgG অ্যান্টিবডি পূর্ববর্তী সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়। এটি মূলত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই করতে সহায়ক।

CBC (Complete Blood Count) টেস্টঃ ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য রক্তের প্লেটলেট কাউন্ট এবং শ্বেত রক্তকণিকার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হয়। CBC পরীক্ষার মাধ্যমে প্লেটলেটের সংখ্যা ও রক্তে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের মাত্রা জানা যায়, যা রোগের তীব্রতা নির্ধারণে সহায়ক।

ডেঙ্গু রোগ সঠিকভাবে এবং দ্রুত সনাক্তকরণের জন্য Arogga আপনার বিশ্বস্ত সহযোগী হতে পারে। তাদের ডেঙ্গু NS1 Ag টেস্ট সেবা দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট প্রদান করে। আরোগ্য থেকে আপনি ঘরে বসেই এই পরীক্ষা করতে পারবেন, এবং পরীক্ষার ফলাফল দ্রুত পাবেন। আরও জানতে বা টেস্ট বুক করতে, Arogga-র Dengue test দেখুন।

ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা

ডেঙ্গু রোগের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই, তবে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নিয়ে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব। রোগের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা কিছু ভাগে ভাগ করা যায়ঃ 

হালকা ডেঙ্গুর চিকিৎসা

ডেঙ্গুর সাধারণ বা হালকা তীব্রতার জন্য ঘরে বসে বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও তরল পানীয় গ্রহণ এবং প্যারাসিটামল সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এসপিরিন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ব্যথানাশক এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের চিকিৎসা

ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। এই ধরণের ডেঙ্গুতে রোগীর শরীরে রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্তপাত হওয়া এবং প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হাসপাতালে রোগীকে IV ফ্লুইড (Intravenous Fluid) দিয়ে শরীরে তরলের মাত্রা বজায় রাখা এবং প্লেটলেট পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের (DSS) চিকিৎসা

ডেঙ্গু শক সিনড্রোম সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং জটিল প্রকারভেদ। এই অবস্থায় রোগীর রক্তচাপ হঠাৎ করে অনেকটা কমে যেতে পারে, যার ফলে শক অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই ধরণের রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয় এবং প্রয়োজনীয় IV ফ্লুইড ও ওষুধ দিতে হয়।

ডেঙ্গু রোগের খাবার

ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে প্রচুর পানি, ফলের রস, স্যালাইন ইত্যাদি খাওয়া উচিত। ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণত হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়, যা শরীরে শক্তি যোগাতে সহায়ক। নিচে ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে এবং ডেঙ্গু হলে কি খাবার খাওয়া যাবে না তা একটি ছকে তুলে ধরা হলো।

খেতে হবেখাওয়া যাবে না
প্রচুর পানি, ডাবের পানি, ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয়অতিরিক্ত মশলাদার ও ঝাল খাবার
তাজা ফল যেমন পেঁপে, কমলা, আপেল, কলা, এবং বেদানাভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবার
পুষ্টিকর স্যুপ, বিশেষ করে সবজি ও মুরগির স্যুপখুব ঠান্ডা পানীয় বা আইসক্রিম
হালকা খাবার যেমন খিচুড়ি, সেদ্ধ ডাল, এবং ওটমিলকোল্ড ড্রিঙ্কস ও সফট ড্রিঙ্কস
পর্যাপ্ত প্রোটিনের জন্য ডিমের সাদা অংশ এবং মাছের ঝোলপ্রসেসড ফুড বা প্যাকেটজাত খাবার
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলের রস, যেমন লেবুর রসক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (চা, কফি)

সর্বোপরি ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাধ্যতামূলক। নিয়মিত CBC টেস্ট ও প্লেটলেট কাউন্ট পরীক্ষা করা উচিত, যাতে রোগের অবস্থার ওপর নজর রাখা যায়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়

ডেঙ্গু প্রতিকারে করণীয় হিসেবে মূলত মশার বিস্তার রোধ ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়া জরুরি। 

  • মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা: যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, সেসব স্থানে নিয়মিত পানি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ফুলের টব, ব্যবহৃত টায়ার, কনটেইনার বা ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি ফেলে দিয়ে মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা যেতে পারে।
  • ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থাঃ মশারি ব্যবহার, মশা নিরোধক ক্রিম ও স্প্রে ব্যবহার, এবং রাতে দীর্ঘ হাতাওয়ালা পোশাক পরা ডেঙ্গু থেকে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় এগুলো মেনে চলা উচিত।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর যত্ন ও সহায়তা

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর দ্রুত সুস্থতার জন্য সঠিক যত্ন ও সহায়তা অপরিহার্য। ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম, তরল পানীয়, এবং পুষ্টিকর খাবার দেওয়া উচিত যাতে শরীরের শক্তি বজায় থাকে। রোগীকে নিয়মিত পানি, স্যালাইন, ফলের রস ইত্যাদি খাওয়ানো প্রয়োজন, কারণ ডেঙ্গুতে শরীরের পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। 

এছাড়া প্লেটলেট কাউন্ট ও CBC টেস্ট নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে রোগের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। যদি রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে বা শ্বাসকষ্ট, তীব্র পেটে ব্যথা বা বমি দেখা যায়, তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। আপনার মানসিক সহায়তা ও সঠিক পরিচর্যা ডেঙ্গু রোগীর দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য সহায়ক।

ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কতা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা ও সতর্কতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেঙ্গু সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সঠিক তথ্য প্রদান, মশা নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে অবহিত করা এবং ডেঙ্গুর লক্ষণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানানো উচিত। জনসমাগমপূর্ণ এলাকায়, যেমন স্কুল, অফিস, বাজার ইত্যাদিতে সচেতনতা এসব কর্মসূচি চালু করা দরকার। এছাড়াও ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যক্তিগত সতর্কতা, এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত। 

উপসংহার

আমরা জানলাম, ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার। এ রোগের লক্ষণগুলো যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা ইত্যাদি সম্পর্কে জানা আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, সঠিক সময়ে ডেঙ্গু টেষ্ট, ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, মশারি ব্যবহার, ও জমে থাকা পানি অপসারণের মাধ্যমে ডেঙ্গু থেকে নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।